
আসানসোল, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ হৃদয়ে বেজে উঠেছে গাজনের ঢাক-ঢোল। শিবের আরাধনায় মগ্ন গাজন সন্ন্যাসীদের তপস্যা ও ভক্তির মহোৎসব এখন পূর্ণমাত্রায় পালিত হচ্ছে। আসানসোলের গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এই লোকউৎসব জনমানসে জাগিয়ে তুলছে এক অনন্য আধ্যাত্মিক জোয়ার। আসানসোলের চন্দ্রচুর বাবার মন্দির, বুধা গ্রাম সহ বিভিন্ন এলাকায় এই উৎসবের উন্মাদনা দেখার মতো।


আসানসোলে গাজনের রঙিন আয়োজন
আসানসোলের গ্রামগুলিতে গাজন উৎসব পালিত হচ্ছে মহা সমারোহে। চন্দ্রচুর বাবার মন্দিরে ভোর থেকেই শিবভক্তরা জড়ো হন। ঢাক-ঢোলের তালে, মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। বুধা গ্রামে সন্ন্যাসীরা গ্রাম পরিক্রমা করেন, তাদের হাতে ত্রিশূল আর শরীরে লৌহশলাকা বিদ্ধ। এই কঠিন তপস্যার মধ্য দিয়ে তারা শিবের কাছে প্রার্থনা করেন গ্রামের মঙ্গল ও সমৃদ্ধির জন্য।
সন্ন্যাসীদের তপস্যার অপূর্ব দৃশ্য
গাজন উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হল সন্ন্যাসীদের কৃচ্ছ্রসাধন। ত্রিশূল হাতে নিয়ে তারা বুকে, কানে, জিহ্বায়, পিঠে এবং পেটে লোহার শলাকা বিদ্ধ করেন। এই দৃশ্য যেমন বিস্ময়কর, তেমনই ভক্তির গভীরতায় মন ছুঁয়ে যায়। আগুনঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ, বঁটিঝাঁপের মতো আচারগুলি এই উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সন্ন্যাসীরা এই কঠোর তপস্যার মাধ্যমে শিবকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। আসানসোলের গ্রামগুলিতে এই বছরও ভক্তদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে চড়কতলা।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে গাজন
শুধু আসানসোল নয়, পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, নদিয়া ও বীরভূমের মতো জেলাগুলিতেও গাজন উৎসব পালিত হচ্ছে। মালদহে এই উৎসব ‘গম্ভীরা’ নামে পরিচিত, আর জলপাইগুড়িতে বলা হয় ‘গমীরা’। চৈত্র সংক্রান্তির সময় চড়ক পুজোর মধ্য দিয়ে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। কোথাও মুখোশ নৃত্য, কোথাও কালীনাচ, কোথাও আবার সঙ সেজে শিব-গৌরীর লীলাভিনয় গাজনের আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
গাজনের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
গাজন শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময় শিব ও পার্বতীর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়, আর সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন। গ্রামের জনগণ এই উৎসবের মাধ্যমে সূর্য ও পৃথিবীর মিলনের প্রতীকী উদযাপন করেন, যা কৃষিজীবী সমাজের জন্য বৃষ্টি ও ফসলের সমৃদ্ধির প্রতীক। জাতপাতের ভেদাভেদ ভুলে সকলে এই উৎসবে একসঙ্গে অংশ নেন, যা বাঙালির সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন।
চড়ক পুজোর উৎসাহ
গাজনের শেষ দিনে চড়ক পুজোর আয়োজন হয়। উঁচু কাষ্ঠদণ্ডে ঝুলে সন্ন্যাসীরা ঘুরপাক খান, আর নীচে দাঁড়িয়ে ভক্তরা বেল, কাঁচা আমের মতো ফল ধরার জন্য উৎসাহিত হন। এই ফল ধরা ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। আসানসোলের গ্রামগুলিতে এই বছরও চড়কের এই দৃশ্য ছিল দর্শনীয়।
স্থানীয়দের উৎসাহ ও ভক্তি
আসানসোলের বুধা গ্রামের এক সন্ন্যাসী বলেন, “গাজন আমাদের জন্য শুধু উৎসব নয়, এটি শিবের কাছে নিজেকে সমর্পণের একটি মাধ্যম। ত্রিশূল হাতে, শরীরে শলাকা বিদ্ধ করে আমরা গ্রামের মঙ্গল কামনা করি।” স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই উৎসব তাদের গ্রামের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকলেই এই উৎসবে অংশ নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন।
উপসংহার
গাজন উৎসব বাংলার লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। আসানসোল থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এই উৎসব ভক্তি, তপস্যা ও সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য মেলবন্ধন তৈরি করে। চৈত্রের এই শেষ সপ্তাহে গ্রামবাংলা যেন শিবের আরাধনায় এক অনন্য রঙে সেজে ওঠে। ‘বাংলার জাগরণ’ নিউজ পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেলের পক্ষ থেকে সকলকে গাজন উৎসবের শুভেচ্ছা।